রুমনের মা তাকে চারবেলা খাওয়াতে নাজেহাল হয়ে যায়। অগত্যা টিভিই ভরসা তার মায়ের। পছন্দসই কার্টুন চালিয়ে দিলেই তা হাঁ করে দেখতে বসে যায় রুমন। মায়ের ও হাত চলতে থাকে দ্রুত তাকে খাওয়ানোর জন্য। সেক্ষেত্রে মাও খুশী,বাচ্চাও খুশী। কিন্তু সমস্যা বাঁধল অন্য জায়গায়। আড়াই বছরের রুমন অন্য কোথাও গিয়ে খাওয়াদাওয়া করতে চায়না। কারন বাড়ীর ওই পরিবেশে ওই কার্টুন টাই চাই তার খাবার সময়। তা না হলে জেদ, কান্নাকাটি , শেষে কাঁদতে কাঁদতে বমি এসব তার নিত্যদিনের উপসর্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
পরের ঘটনাটি সালোনিকে নিয়ে। প্রি স্কুলে পড়া তিন বছরের সালোনি মা বাবার সাথে ইন্টারভিউ দিতে গেছে। তার ইন্টারভিউ হয়ে যাওয়া মাত্রই সে ছুট্টে তার মা বাবার কাছে চলে এসে মোবাইল ফোন নেবার বায়না করতে শুরু করল। তার মা বাবা তখন প্রিন্সিপালের সামনে ইন্টারভিউ দিতে ব্যস্ত। কিন্তু সালোনি এক মুহূর্ত অপেক্ষা করতে রাজী নয়। সেই মুহূর্তে তার মোবাইল ফোন চাই ই চাই। সে তখন গেমস খেলবে। মা বাবার হাজার বারণও সালোনি কে নিরস্ত করতে পারলনা। উপরন্তু সে শুরু করল প্রচন্ড ট্যানট্রাম। বলাই বাহুল্য সেই স্কুলে সালোনি পড়ার সুযোগ পায়নি।
ছোট্ট ঋক্ ভারী মিষ্টি স্বভাবের ছেলে ছিল। ওর পাঁচ বছরের জন্মদিনে ওর মা বাবা ওকে একটি ভিডিও গেম উপহার দেয়। তারপর থেকে ঋকের স্বভাবের বহু পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। কার রেসিং খেলা ছাড়া ঋক এক মুহূর্ত থাকতে পারেনা। এমনকি স্কুল যেতে বা বন্ধুবান্ধবদের সাথে মিশতেও সে পছন্দ করেনা আজকাল। উপরন্তু সে ভয়ঙ্কররকম আক্রমনাত্মক হয়ে উঠেছে। সব কিছু ভেঙে ফেলার উপসর্গও দেখা যাচ্ছে আজকাল তার মধ্যে।
উপরোক্ত তিনটি ঘটনাই আজকাল শহর ও শহরতলির বাচ্চাদের দৈনন্দিন জীবনের খুব চেনা ছবি। বাচ্চাদের মধ্যে টি.ভি, মোবাইল বা ভিডিও গেমের প্রতি যে আসক্তি তৈরী হচ্ছে তার জন্য অনেকাংশে দায়ী আমাদের ভুল পেরেন্টিং।
কী ভাবে তৈরী হয় এই আসক্তি
টি.ভি, মোবাইল গেম বা যে কোনো ধরনের ভারচুয়াল এন্টারটেনমেন্ট দেখার সময় আমাদের মস্তিষ্কের কোষ থেকে ক্ষরণ হয় এক ধরণের নিউরোট্রান্সমিটার, যার নাম ডোপামিন। এই ডোপামিনের ক্ষরণ আমাদের মনে এক ভাললাগার অনুভূতি সন্চার করে। তার ফলে অতি সহজেই আমরা এই ধরনের এন্টারটেনমেন্ট মিডিয়াম গুলোতে আসক্ত হয়ে পড়ি। বাচ্চাদের ক্ষেত্রে আমাদের বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখা উচিত যতটা কম ডোপামিনের ক্ষরণ হয়।
কিভাবে বাচ্চাদের এই ধরনের আসক্তি গুলো থেকে দূরে রাখবেন?
১। প্রথমত: বাচ্চা যদি ছোট হয়(৫ বছর অবধি) বাড়ীতে টি.ভি রোস্টার মেনে চলার চেষ্টা করুন। বাচ্চার হাতে কোন পরিস্থিতিতেই মোবাইল ফোন বা ভিডিও গেম তুলে দেবেন না। নিজের মধ্যে স্বচ্ছ ধারনা তৈরী করুন, বাড়ীর খুব দরকারী গ্যাজেটের মতন মোবাইল ফোনও একটি অতি প্রয়োজনীয় জিনিস, বাচ্চার খেলার সামগ্রী নয়। বাড়ীর ওয়াশিং মেশিন, মাইক্রোওয়েভ এসব নিয়ে কি ও খেলা করে? নিশ্চয় নয়। মোবাইল ফোনকেও সেভাবে মা বাবারা যদি চিহ্নিত করেন তাহলে বাচ্চারা অবশ্যই বুঝবে ব্যাপারটা। বাচ্চা একটু বড় হয়ে গেলে তাদের বোঝান উচিত টি.ভি বা মোবাইলের আসক্তির খারাপ ফল গুলো।
২। বাচ্চাদের একাকিত্ব দূর করার চেষ্টা করুন। আজকাল বেশীরভাগ পরিবারই নিউক্লিয়ার। তাই বন্ধু ও পরিজনহীন বাড়িতে টি.ভিকেই তারা পরম বন্ধু করে নেয়। অনেকসময় মা বাবা দুজনেই চাকরীরত হলে বাচ্চার কেয়ার গিভার তাকে টি.ভির সামনে বসিয়ে নিজের কাজ সারেন। ক্রমে বাচ্চা আসক্ত হয়ে পড়ে টি.ভিতে।
বাচ্চার জন্য বিভিন্ন ধরনের অ্যাক্টিভিটির প্ল্যান করুন। আজকাল বিভিন্ন অ্যাকটিভিটি সেন্টার রয়েছে যারা নাচ, গান, গল্প বলা, মিউজিকাল ইন্স্ট্রুমেন্ট শেখায়। বিকেলবেলাটা বাচ্চাকে সে সবের মধ্যে থাকতে শেখান। তাতে সমবয়সী বাচ্চাদের সাথে সময়ও কাটাতে পারবে, ওদের একাকিত্বও ঘুচবে।
৩। বাচ্চার মধ্যে বই পড়ার অভ্যাস তৈরী করুন। ছোটোবেলা থেকে রোজ রাত্তিরে শোবার আগে বাচ্চাকে যদি বই থেকে গল্প পড়ে শোনানোর অভ্যাস তৈরী করা হয় তাহলে বাচ্চাদের মধ্যে বই পড়ার প্রবণতাও বাড়ে। তখন টি.ভি, মোবাইল বা ভিডিও গেমের আসক্তি থেকে অনেক সহজেই বাচ্চাকে দূরে রাখা যায়।
৪। মাঝে মাঝে বাচ্চাদের নিয়ে প্লে ডেট তৈরী করুন। ওদের খেলার সাথে নিজেরাও মেতে উঠুন। দেখবেন ওরা অনেক বেশী উপভোগ করছে ওদের শৈশবকে।
৫। অনেক সময় বিভিন্ন কার্টুন ক্যারেক্টার বা মোবাইল গেমস বাচ্চাদের ভায়োলেন্ট করে তোলে। কার্টুনে দেখান বিভিন্ন মারপিট বা মোবাইল গেমের কার ক্র্যাশিং খেলা বাচ্চাদের মানসিক স্বাস্থ্যের ব্যাঘাত ঘটায়। তারা অতিরিক্ত হাইপারঅ্যাক্টিভ বা অ্যাগ্রেসিভ হয়ে ওঠে। তাই লক্ষ্য রাখুন কী ধরণের প্রোগ্র্যাম বাচ্চারা দেখছে। সেক্ষেত্রে বাচ্চার সাথে একসাথে বসে ওকে সঠিক ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিন।
৬। বাচ্চাদের কখনই বড়দের সোপ সিরিয়াল বা ক্রাইম প্যাট্রল জাতীয় প্রোগ্র্যাম দেখতে দেবেন না। আমরা বড়রা অনেকসময়ই এ ব্যাপারে নিয়ন্ত্রন রাখতে পারিনা, তার ফলে অচিরেই বাচ্চাদের মনের মধ্যে অকারণ জটিলতা, ভয় বা আতংকের সৃষ্টি হয়। নানারকম মানসিক রোগে আক্রান্ত হতে পারে তারা। শুধু তাই নয়, যে কোনো কাজে মনসংযোগ করতেও তাদের অসুবিধে হয়।
৭। বাচ্চাদের কম্পিউটার ব্যবহার করতে দিন সময় মেপে। ল্যাপটপ বা কম্পিউটার বাড়ীর এমন একটি জায়গায় রাখুন যাতে তা বড়দের চোখের সামনে থাকে। তাতে বাচ্চারা কী ধরণের বিষয় নিয়ে ইন্টারনেটে নাড়াচাড়া করছে তা সমন্ধে একটা ধারণা পাওয়া যায়।
৮। মা বাবার একটা সম্যক জ্ঞান থাকা দরকার ইন্টারনেট বা সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইট সমন্ধে। প্রয়োজনে সিকিউরিটি সিস্টেম আপডেটেড রাখুন।
৯। বাচ্চাকে খাওয়ানোর সময় বা ঘুমোতে যাবার আগে কোনো ধরণের গ্যাজেটের অভ্যাস রাখবেননা। আজকালকার দিনে আপাতভাবে এটা শুনে অসম্ভব মনে হলেও কয়েকদিন অভ্যেস করলেই এটা সহজ হয়ে উঠবে। বরং গল্প বলুন বা বই পড়ুন ওই সময়ে। বাচ্চা অনেক ধরনের প্রশ্ন করতে শিখবে, নতুন বিষয় সমন্ধেও জ্ঞান বাড়বে। ঘুমোতে যাওয়ার আগে মন বিক্ষিপ্তও থাকবেনা।
১০। উপরোক্ত সব কিছুই সম্ভব হবে যদি বাবা মা সঠিকভাবে সব কিছু প্ল্যান করেন। এর জন্য নিজেদের বাচ্চাদের সামনে রোল মডেল হিসেবে তুলে ধরতে হবে। মোবাইলে গেম খেলা বা টি.ভি দেখার অভ্যেস মা বাবার মধ্যে যতটা নিয়ন্ত্রিত হয় ততই উপকৃত হবে আপনার সন্তান।